রাসূলের ভালােবাসা। মহান আল্লাহর সীমাহীন অনুগ্রহ, তিনি আমাদেরকে ইসলামী পরিমণ্ডলে সৃষ্টি করেছেন। ঈমান গ্রহণের সৌভাগ্যও দিয়েছেন। তাঁর ভালােবাসা ও তাঁর প্রিয় রাসূল হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ভালােবাসায় আমাদেরকে গৌরবান্বিত করেছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র সত্তা এতােটাই মনােমুগ্ধকর যে, আল্লাহ নিজেই তাকে ভালােবাসেন। সকল নবী-রাসূলও তাকে ভালােবাসেন। ভালােবাসেন ফেরেশতাগণ। জান্নাতও তাঁকে ভালােবাসে। তাকে ভালােবাসে বনের প্রাণীরা, সাগরের মাছ, গাছ, পাথর, এমনকি সমগ্র পৃথিবীর প্রতিটি বস্তু। লাওহে মাহফুয, তাকদীরের কলম; আল্লাহর আরশ ও কুরসী; সবকিছুই তাকে ভালােবাসে। গােটা বিশ্বজাহান
ইউসুফের রূপ, ঈসার ফুক আর মূসার শুভ্র বরণ,
তাদের সবার গুণ ও রূপের তােমাতেই সম্মিলন। এ কারণেই তার প্রতিই সবচে বেশি ভালােবাসা লালন করতে হবে। তাঁকে নিজের জন্মদাতা পিতা থেকে, আদরের সন্তান থেকে, ভালােবাসার মানুষ থেকেও বেশি ভালােবাসতে হবে। বিবেক ও উপলব্ধি আমাদেরকে তাই নির্দেশ করে। সেমতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্পষ্ট ঘােষণা করেছেন : যতক্ষণ আমি তােমাদের কাছে তােমাদের পিতা, তােমাদের সন্তান এমনকি পৃথিবীর সকলের চে’ বেশি প্রিয় হতে পারব না ততক্ষণ পর্যন্ত তােমরা খাঁটি মুমিন হতে পারবে না। অন্য বর্ণনায় এসেছে।
عن أنس رضي الله تعالى عنه عن النبي صلى الله عليه وسلم، قال : ثلاث من كن فيه وجد حلاوة الإيمان : من كان الله ورسوله أحب إليه مما سواهما.
‘যেই ব্যক্তির মাঝে নিম্নের তিনটি বিষয় পাওয়া যাবে, সে ব্যক্তি ঈমানের স্বাদ অনুভব করতে পারবে। প্রথম বিষয় হলাে, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে সবকিছুর চে' বেশি ভালােবাসতে হবে।
| [বুখারী ও মুসলিম] তাইতাে যদি কোনাে মুসলমান তার স্ত্রী-সন্তান অথবা নিজ বংশকে খুব বেশি ভালােবাসে, কিংবা ব্যবসা-বাণিজ্য বা উপার্জিত সম্পদ অথবা বাড়িঘর ইত্যাদিকে খুব বেশী ভালােবাসে আর তার তুলনায় আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি তার ভালােবাসা অপ্রতুল হয়ে থাকে অথবা আল্লাহর পথে জিহাদ তাকে কাছে না টানে তাহলে তাকে মুমিন বলা যাবে না। তার ব্যাপারে আল্লাহর পক্ষ থেকে কুরআনুল কারীমে কঠোর হুঁশিয়ারি এসেছে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন :
قل إن كان آباؤكم وأبناؤكم وإخوانكم وأزواجه و یته و اموال
ون گشادها و ملک ترضونها أحب إليه من اقترفوها وتجار
রাসূলপ্রেমের একগুচ্ছ গল্প করে থাকে যে, এর মাঝে সে সুস্থতার আশা খুঁজে পায়। এটাই হচ্ছে মহব্বতে আকলি। মনের চাওয়া না চাওয়ায় কী আসে যায়? অসুস্থতার সময় সুস্থতার প্রয়ােজনে এগুলােকে সে প্রাধান্য দিয়ে থাকে। তেমনি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের হুকুমের প্রতি মন আকৃষ্ট হােক বা না হােক; নিজের বিবেকের অভিপ্রায়ে তা মেনে নিতে হবে। অন্য সবকিছুর ওপর সেটিকেই প্রাধান্য দিতে হবে। যদি আল্লাহ ও তাঁর রাসূল জিহাদের আদেশ দেন, তাহলে শুধু আল্লাহর ওয়াস্তে জিহাদের জন্যে প্রস্তুত হতে হবে। তখন জীবন উৎসর্গের কোনাে পরােয়াই করা যাবে না। আল্লাহর পথে লড়াই করে শহীদ হওয়ার জন্যে যে কোনাে কষ্ট হাসিমুখে বরণ করে নিতে হবে। যদি নিজের সন্তানও শরীয়তপরিপন্থী কোনাে কাজ করবে বলে জেদ ধরে বসে থাকে, অথচ আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সেই কাজ থেকে বারণ করেছেন তাহলে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের কথাই মেনে নিতে হবে। নিজের বিবেককে এ কথা বলে প্রশান্ত করতে হবে যে, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের কথা মেনে নেয়ার মধ্যেই আমার সার্বিক নিরাপত্তা। মােটকথা, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সম্ভষ্টিকে সবকিছুর ওপর প্রাধান্য দিতে হবে। তাহলেই বলা যাবে যে, অন্য সব ভালােবাসার ওপর তাঁদের ভালােবাসা প্রাধান্য পেয়েছে। আর তখনই সে পূর্ণ মুমিন হতে পারলাে। হযরত সাহাবায়ে কেরাম রিযওয়ানুল্লাহি তা'লা আজমাঈন পূর্ণ ভালােবাসার এই স্তরে উন্নীত হয়েছিলেন। উদাহরণস্বরূপ, হযরত ওমর ফারুক রা. সম্পর্কে বর্ণিত আছে যে, যখন তিনি এই হাদীস শুনলেন তখন নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে উপস্থিত হয়ে নিবেদন করলেন : হে আল্লাহর রাসূল! আমি আমার জীবন ছাড়া অন্য সব কিছুর চেয়ে আপনাকে বেশি ভালােবাসি। উত্তরে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন : সেই সত্তার শপথ! যার হাতে আমার জীবন। তখন পর্যন্ত তােমরা পরিপূর্ণ মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না তােমরা আমাকে তােমাদের জীবনের চেয়েও বেশি ভালােবাসবে। এসময় নবীজির তাওয়াফ্লুহে অর্থাৎ মনস্তাত্ত্বিক বিকিরণের মাধ্যমে হযরত ওমরের হৃদয়ে এমন প্রভাব গড়ে ওঠে যে, তিনি তৎক্ষণাৎ বলে ওঠেন
তাঁর ভালােবাসায় বিভাের হয়ে আছে। তাঁর ভালােবাসায় ব্যাকুল হয়ে বাতাস বয়ে যায়। সমুদ্রের তরঙ্গ উদ্বেলিত হয়। সেই রাসূলের উম্মত হিসেবে আমাদেরকে সৃষ্টি করার মাধ্যমে আল্লাহ তা’লা আমাদের প্রতি তাঁর রহমত ঢেলে দিয়েছেন। অথচ এই নেয়ামতের প্রবল আকাঙ্খয় অনেক বড় বড় নবী-রাসূলও আল্লাহর দরবারে হাত তুলেছেন। আল্লাহ আমাদেরকে তাঁর উম্মত বানিয়ে আমাদেরকে ভালােবাসা ও সৌহার্দের দৌলত দান করেছেন। পৃথিবীতে এরচে' বড় কোনাে দান হতে পারে না। এই দান যেভাবে দুনিয়াতে আমাদের জন্যে জীবনের পুঁজি, তেমনি পরকালে মুক্তির চাবিকাঠিও বটে। এই প্রাচুর্য্যের ওপর আমরা যতটাই গর্ববােধ করি না কেনাে; নিতান্তই কম হবে। মহান আল্লাহর পরই তাঁর রাসূলের আসন। তাঁর গুণাবলী ও বৈশিষ্ট্য ছিল অতুলনীয়। তাঁর নাম, তার স্থান সর্বদিক থেকেই ঊর্ধ্বে। তাঁর মাঝেই উত্তম গুণাবলী ও চারিত্রিক উৎকর্ষের সমাবেশ ঘটেছিল। তাঁর অবয়ব, তাঁর আখলাক ছিল অনন্য। তিনি জগদ্বাসীর জন্যে রহমত ছিলেন। তিনিই গুনাহগারদের সুপারিশকারী। আমাদের মতাে উম্মতদের জন্যে তিনিই ভরসা। মােটকথা, তার মাঝে ছিল সমস্ত গুণের সমাবেশ। কবি বড় যথার্থই বলেছেন :
کشف الدجی بجماله صلوا عليه وآله.
بلغ العلى بكماله حسنت جمیع خصاله
শিখর ছুঁয়েছেন তিনি আপন পূর্ণতায়। কেটেছে তমসা তার আলােকোচ্ছটায়। তার সকল গুণাবলী অতি সুন্দর।
রহমত ঝরুক তাঁর ও তাঁর স্বজনের পর। কারাে প্রতি ভালােবাসা তখন গড়ে ওঠে, যখন তার কোনাে রূপ বা সৌন্দৰ্য্য অথবা গুণ ও বিম্র আচরণ মন কেড়ে নেয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন পৃথিবীর সমস্ত সৌন্দৰ্য্য, সমস্ত পূর্ণতার আধার। চমত্তার সব বৈশিষ্ট্যের সুন্দর চিত্রায়ণ ঘটেছিল তার মাঝে । তার মাঝে প্রশংসনীয় গুণাবলীর পূর্ণ বিকাশ ঘটেছিল। তাঁর মহৎ আচরণের সঙ্গে অন্য কিছুরই তুলনা হতে পারে না। তিনি ছিলেন অতি মহৎ ও অতি মহান।
ا
ه القوم الفقين
‘আপনি বলুন, তােমাদের নিকট যদি তােমাদের পিতা, তােমাদের সন্তান, তােমাদের ভাই, তােমাদের স্ত্রী, তােমাদের বংশ, তােমাদের ধন-সম্পদ, তােমাদের ব্যবসায় তােমরা যার মন্দা পড়ার আশঙ্কা করাে এবং তােমাদের বাসস্থান -যাকে তােমরা পছন্দ করাে- আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও তার রাস্তায় জিহাদ। করার চেয়ে অধিক প্রিয় হয় তাহলে অপেক্ষা করাে আল্লাহর বিধান আসা পর্যন্ত। আর আল্লাহ ফাসিক সম্প্রদায়কে সঠিক পথ প্রদর্শন করেন না।
[সূরা তাওবাহ : ২৪]
ভালােবাসার রকমফের আলেমগণ বলেন : বিভিন্ন আয়াত ও হাদীসে নবীজির প্রতি যেই মহব্বত থাকতে বলা হয়েছে, সেই মহব্বত দ্বারা উদ্দেশ্য হলাে, মহব্বতে আকলি বা ইচ্ছাসৃষ্ট প্রেম। এর দ্বারা মহব্বতে তাবঈ বা মনের অজান্তে সৃষ্টি হওয়া ভালােবাসা উদ্দেশ্য নয়। কেননা নিজ স্ত্রী, সন্তান, ভাই-বেরাদার ও পরিবারের প্রতি ভালােবাসা হয়ে যাওয়া কিংবা ব্যবসায়-বাণিজ্যের প্রতি ভালােবাসা বােধ করা একান্তই প্রাকৃতিক ব্যাপার। এক্ষেত্রে মানুষ নিতান্তই বাধ্য। মানুষ যদি এগুলােকে ইচ্ছে করে ভালােবাসতে নাও চায়, তবুও প্রাকৃতিকভাবে নিজের অজান্তেই এগুলাের প্রতি তার ভালােবাসা এসে যাবে। ভালােবাসার দ্বিতীয় প্রকার যাকে মহব্বতে আকলি বা ইচ্ছাসৃষ্ট ভালােবাসা বলা হয়, এক্ষেত্রে সেটাই উদ্দেশ্য। মন যদি নাও চায়, তবুও বিবেকের শাসনে নিজেকে সে ভালােবাসার দিকে টেনে নিয়ে যেতে হবে। যেমন, যখন মানুষ অসুস্থ হয় তখন ঔষধপথ্যের দিকে নিজেই নিজেকে ইচ্ছে করে আকৃষ্ট করে থাকে। তখন বিবেকের চাপে নিজ ইচ্ছেতেই সে ঔষধ খেয়ে থাকে। ইনজেকশনও পুশ করে। রক্ত ও মল-মূত্রেরও মেডিকেল টেস্ট করিয়ে নেয়। এমনকি অপারেশনও প্রয়ােজন হলে করে থাকে। তখন সে খাবার-দাবারের ক্ষেত্রে যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করে। এসব সে এজনে