বাঙালির ইতিহাস নেই - এই আক্ষেপ করেছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। পরমুহূর্তে সমাধান বাতলে দিয়ে লিখেছিলেন বাঙলার অতীত কাহিনি বাঙালিকেই লিখতে হবে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পেরোনো বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির সবচেয়ে রোমাঞ্চকর পর্যায় মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী পাঁচ বছর। এত ঘটনাবহুল সময় একাত্তর ব্যতীত এই জাতির জীবনে কখনো এসেছে কিনা তা নিয়ে বির্তক বিশেষ থাকার কথা নয়। বঙ্গবন্ধু শাসনামল নিয়ে অনেক গদ্যগাঁথা লেখা হয়েছে। স্মৃতিকথা,আত্মকথা কিংবা গবেষণাধর্মী বইও কমবেশি প্রকাশিত হয়েছে সেই সময় নিয়ে। ফেসবুক সেলেব্রিটি পিনাকী ভট্টাচার্যের বঙ্গবন্ধু শাসনামল নিয়ে লেখা 'স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশ' বইটি আরও একটি নতুন সংযোজন বটে।
বিজেপি ভারতের সকল দুঃখ-দুর্দ্দশার জন্য নেহেরুকে দায়ী করতে পছন্দ করে। পিনাকী ভট্টাচার্যের বইটি পড়ে আমার মনে হলো বাংলাদেশের বিদ্যমান সকল প্রতিবন্ধকতার মূল হিসেবে তিনি স্বাধীনতাত্তোর আওয়ামী লীগের কর্মকাণ্ড ও শেখ সাহেবকে দায়ী করতে চান। ও হ্যাঁ, সরাসরি নয় ; পরোক্ষভাবে।
ইতিহাস নিয়ে লেখালিখি অনেকটা রান্নায় লবণ দেওয়ার মতো। মাত্রাতিরিক্ত হলে খাওয়া যায় না, আবার আলুনির কারণে স্বাদ নষ্ট হয়। মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দানকারী দল হিসেবে আওয়ামী লীগের একটি অহংবোধ সবসময় ক্রিয়াশীল। তাই সদ্যস্বাধীন দেশে বিরোধী দলগুলোকে দলটি মূল্যায়ন করতে ব্যর্থ হয়েছে৷ রাজি হয়নি আওয়ামী লীগ-বহির্ভূত দল ও ব্যক্তিদের যুদ্ধকালীন গৌরবময় ভূমিকাকে সরলভাবে স্বীকার করতে। তাই তো আওয়ামী লীগের থেকেই জন্ম নিয়েছিল তাদের সবচেয়ে বড়ো প্রতিপক্ষ জাসদ। কেন জাসদসহ কিছু বামপন্থিদল বঙ্গবন্ধু সরকারের প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়াল তা নিয়ে কোনো বিশ্লেষণ পিনাকী ভট্টাচার্যের নেই। তিনি বিভিন্ন জনের বই থেকে স্রেফ তথ্যসূত্র উল্লেখ করে ঘটনা তুলে ধরেছেন। কী ঘটছে তা পাবেন। অথচ কেন ঘটেছে সেই উত্তর পিনাকীর বইতে নেই।
বঙ্গবন্ধুকে বহুমাত্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করা আবশ্যক। তিনি মানুষ ছিলেন। তাই দোষ-ত্রুটির উর্ধ্বে তিনি নন - এই সরল সত্য স্বীকার করে নিলে পিনাকী ভট্টাচার্যের শেখ সাহেবকে 'ভিলেন' হিসেবে চিত্রিত করে এই বই লিখতে হতো না কিংবা লিখলেও লোকে তা অখাদ্য বলে বর্জন করতো। প্রশংসা যিনি দাবি করেন, সমালোচনার আঘাত তাকে সইবার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। এদেশে বঙ্গবন্ধুকে এমন উচ্চতায় নিজে যাওয়া হয়েছে যাতে বহুমাত্রিক দিকে থেকে বঙ্গবন্ধুকে দেখার সুযোগ নিঃশেষিত হয়ে গেছে। পথ মাত্র দুটি খোলা, এক. বঙ্গবন্ধুর সকল কীর্তিকে অস্বীকার করে শুধু তার শাসনামলের সীমাবদ্ধতা নিয়ে পিনাকী ভট্টাচার্যের মতো বই লেখা এবং দুই. স্তুতিবাক্য সংবলিত অখাদ্য প্রসব করা। বাংলাদেশের এই মহামানবের ভালো-মন্দ নিয়ে নিরপেক্ষ কোনো লেখালিখির সুযোগ আজ চিরতরে রুদ্ধ।
যারা আজীবন বঙ্গবন্ধুর অন্ধ বিরোধিতা করে এসেছেন, তারা বইটিকে ঐশী কেতাবের মর্যাদা দিতে পারে। আবার, যারা শেখ সাহেবের দলদাস, তারাও সমস্বরে পিনাকীকে গাল দিতে পারেন। আমি বলব পিনাকী ভট্টাচার্য বইটি লিখেছেন শতভাগ অসৎ মনোভাব নিয়ে। কেন বঙ্গবন্ধুকে ঘৃণা করতে হবে তা প্রচার করাই পিনাকীর উদ্দেশ্য। যা কখনোই একজন খাঁটি লেখকের স্বভাব হতে পারে না।
জাসদের উত্থান পতন, তিনটি সেনা অভ্যুত্থান, বাংলাদেশের রক্তের ঋণ, এক জেনারেলের সাক্ষ্য, শেখ মুজিবের শাসনামল, শতাব্দী পেরিয়ে, বলেছি বলছি বলব প্রভৃতি গ্রন্থ ইতোমধ্যে যারা পড়ে ফেলেছেন, তারা বইটি না পড়লেও ঠকবেন না। কারণ বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এগুলোই তথ্যসূত্র হিসেবে বারবার উল্লেখ করা হয়েছে। ইতিহাসের তথ্যসূত্র হবে ইতিহাসবিষয়ক বিভিন্ন গ্রন্থ, স্মৃতিকথা, আত্মকথা প্রভৃতি। পিনাকী ভট্টাচার্য সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের 'পূর্ব-পশ্চিম'কে তথ্যসূত্র হিসেবে উল্লেখ করেছেন। একটি ফিকশন কীভাবে তথ্যসূত্র হয়!
পিনাকী ভট্টাচার্যের বয়ানের বিপরীত বয়ানওয়ালা অসংখ্য বই রয়েছে। একটা উদাহরণ দিই- তিনি দাবি করেছেন ১৬ ডিসেম্বর ৯৩ হাজার পাকিস্তানি সেনা আত্মসমর্পণ করেনি। কিন্তু এম আর আখতার মুকুলের 'আমি বিজয় দেখেছি' বইতে সুস্পষ্টভাবে ৯৩ হাজারের হিসাব দেওয়া আছে৷ '৭৪ সালে ইত্তেফাকের ফটোসাংবাদিক আফতাব আহমেদের বাসন্তীর জাল পরিহিত ছবির উল্লেখ করে মুজিবের ধবল ধোলাই করেছেন। অথচ একটু পড়াশোনা করলেই জানতে পারতেন চারণসাংবাদিক মোনাজাত উদ্দিন প্রমাণ করে দিয়েছিলেন বাসন্তীকে টাকা দিয়ে এই ভুয়া ছবিটি তুলেছিল আফতাব আহমেদ। হ্যাঁ, চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষের দায় বঙ্গবন্ধু এড়াতে পারবেন না। তবু যে অপরাধ তিনি করেননি, সে-ই দায় তাকে দেওয়া কেন?
ছাত্রলীগের দলীয় কোন্দলে মহসীন হলে সাতজনকে হত্যার ঘটনায় আলোড়ন সৃষ্টি হয়। তখন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শফিউল আলম প্রধানকে সরকার গ্রেফতার করে এবং মামলায় তার সাজা হয়। পিনাকী ভট্টাচার্য এই হত্যাকাণ্ডের কথা লিখেছেন। তবে গোপন করে গেছেন জেনারেল জিয়া এই হত্যাকাণ্ডের দায় থেকে শফিউল আলম প্রধানকে ক্ষমা করে দিয়েছিলেন।
বইটি গতিময়। হয়তো একবসায় পড়তে পারবেন। অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে লেখা ৯৫০ টাকা মূল্যের বইটি একটু বেশিই দামি হয়ে যাবে তাদের জন্য, যারা আমার মতো পিনাকী ভট্টাচার্যের অন্ধ ভক্ত নন। আর হ্যাঁ, বইটিতে চমৎকার কিছু প্রাসঙ্গিক ছবি পাবেন, যেগুলো তে ক্যাপশন লেখার নাম করে 'ইয়া বড়ো বড়ো গরু রচনা' লেখা হয়েছে।
স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশ পিনাকী ভট্টাচার্য দাম,
স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশ পিনাকী ভট্টাচার্য রকমারি,
swadhinata uttar bangladesh (স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশ),
স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশ প্রথম খণ্ড,
মুক্তিযুদ্ধ ধর্ম রাজনীতি ও অন্যান্য প্রসঙ্গ pdf,
স্বাধীনতা ব্যবসায় pdf,
স্বাধীনতা ৭১ pdf download,
পিনাকি ভট্টাচার্য বই,